সকলকে জানাই শ্রী শ্রী রথযাত্রার আন্তরিক শুভেচ্ছা 🙏🙏🙏 শ্রী জগন্নাথ সুভদ্রা বলরাম এর আশীর্বাদ এ সকলে সুস্থ থাকুন ❤🙏
বাংলার প্রখ্যাত ছয়টি রথযাত্রার কথা নীচে বর্ণিত হলো:-
১) মাহেশের রথযাত্রা:- ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা মাহেশের রথ। ১৩৯৬ সালে শ্রী ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী এই রথযাত্রার সূচনা করেন। পরম জগন্নাথ ভক্ত ধ্রুবানন্দ পুরীতে গিয়ে নিজহাতে জগন্নাথ কে ভোগ দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে মন্দির কর্তৃপক্ষ তাঁকে তা করতে দেয়না। ভগ্নহৃদয় ব্রহ্মচারী অনাহারে প্রাণত্যাগ এর সিদ্ধান্ত নিলে স্বয়ং ভগবান জগন্নাথ তাঁর স্বপ্নে এসে তাঁকে মাহেশ অঞ্চলে নদীতে ভেসে আসা নিমকাঠ দিয়ে মূর্তি তৈরি করে ভোগ দেবার কথা বলেন। ধ্রুবানন্দ মাহেশে এসে তাই করেন। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য এই স্থানে নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেছিলেন একবার, তিনি মাহেশকে বলেছেন নব নীলাচল। মহাপ্রভুর দ্বাদশ গোপালের পঞ্চম এবং ৬৪ মহন্তের অন্যতম শ্রী কমলাকার পিপলাই তাঁর আদেশে এই রথযাত্রার ও জগন্নাথ এর পূজার দায়িত্ব পান। পিপলাই এর পরিবার বর্তমানে অধিকারী পদবীধারী এবং আজও জগন্নাথের সেবা করেন। মাহেশের রথযাত্রায় প্রচুর মানুষ আসেন, সাতদিন ধরে বিশাল মেলা হয়..বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর প্রখ্যাত উপন্যাস রাধারানী তে আমরা এই রথযাত্রার উল্লেখ পাই
২) বিষ্ণুপুরের রথযাত্রা:- বিষ্ণুপুরের রথ উৎসব প্রায় ৩৫০ বছরের বেশি প্রাচীন। ১৬৬৫ খ্রীষ্টাব্দে বিষ্ণুপুরের প্রখ্যাত শাসক মহারাজা বীর হাম্বীর মল্ল বিষ্ণুপুর শহরের মাধবগঞ্জে রানি শিরোমণি দেবীর ইচ্ছা অনুযায়ী পাথরের পাঁচ চূড়া মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের বিগ্রহ রাধা মদন গোপাল জিউয়ের। এই মন্দিরের অনুকরণে তৈরি করা হয় পিতলের রথ। এই রথে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা নয় সওয়ার হন শ্রী শ্রী রাধা মদন গোপাল জিউ। মল্লরাজাদের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন দেবতাদের রথে অধিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই শুভ অনুষ্ঠানের সুচনা হয়। থাকেন শ্রী কুঞ্জবিহারী জিউ, শ্রী রাধা বিনোদ বিহারী জিউ, শ্রী কেশব রায় জিউ, শ্রীনিবাস আচার্য প্রতিষ্টিত শ্রী ষড়ভুজ জিউ। প্রাচীন কালের রীতি মেনে সকালে মদন গোপাল জিউ এর মন্দিরে পুজো পাঠ করে মদন গোপাল জিউ এর শালগ্রাম শিলাকে কীর্তন ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে নিয়ে আসা হয় রথে । সেখানে ফের একপ্রস্থ পুজো পাঠ ও আরতি করে প্রথমে ছোট রথ ও পরে বড় রথ টানা হয়। রথযাত্রা উপলক্ষে সাতদিন ধরে চলে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দূরদূরান্ত থেকে আসেন পর্যটকরা, মল্লরাজাদের রাজধানী এই বিষ্ণুপুরে জমে ওঠে রথের আসর
৩) মহিষাদল রাজবাড়ীর রথযাত্রা:- বাংলার মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়ীর প্রখ্যাত রথযাত্রা চলে আসছে গত ২৫০ বছর ধরে। ১৭৭৫ সালে মহিষাদলের রাণি জানকি দেবীর হাত ধরে এই রথযাত্রার সূচনা হয়। ১৮৬০ সালে রাজা লক্ষ্মণপ্রসাদ গর্গের জনৈক ফরাসী বন্ধু মঁসিয়ে পেরু রথ দেখতে আসেন এবং তখনই তিনি রথের প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য একটি নকশা করেন। নকশায় যোগ হয় চারিদিকের ঝুলবারান্দা ও চারকোণের চারটি ঋষি মূর্তি। রাজা সতীপ্রসাদ গর্গ দুটো সাদা ঘোড়া রথের আগে যোগ করেন। মহিষাদল রাজাদের অন্যান্য স্হাপত্যের মতো রথটির কাঠের কাজ মনোমুগ্ধকর। রথের কোণে কোণে লতাপাতার নকশার বদলে হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ প্রভৃতি জানোয়ারের উপর বর্শা হাতে সৈন্য বা নর্তকীদের মিছিল দেখা যায়।প্রথম রথে আরোহণ করেন রাজবংশের আরাধ্য দেবতা গোপাল জিউ।সঙ্গে থাকেন কেবলমাত্র জগন্নাথদেব। ঠিক আগের দিন রাজবংশের আরাধ্য শালগ্রাম শ্রীধর জিউ’কে রথে এনে ‘রথের চক্ষুদান’ উৎসব হয় যা ‘নেত উৎসব’ হিসেবে বহুল জনপ্রিয়। রথযাত্রার সঙ্গে প্রায় ১৫ দিন ধরে বিশাল মেলা। মহিষাদল রাজবাড়ীর রথযাত্রা দেখতে বহু মানুষ ভিড় জমান প্রতিবছর
৪) ধামরাই এর রথযাত্রা:- অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা জেলার ধামরাই এর রথযাত্রার বয়স প্রায় ৪০০ বছর এবং এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম রথযাত্রা। ১০৭৯ বঙ্গাব্দে শুরু হয় এই উৎসব। কথিত আছে পালবংশের জনৈক রাজা যশোপাল এই অঞ্চলে একটি লালমাটির ঢিবি খনন করে মাটির তলা থেকে একটি মাধব মূর্তি পান যা যশোমাধব মূর্তি নামে পূজা হতে থাকে এবং ১০৭৯ বঙ্গাব্দে শুরু হয় রথযাত্রা। প্রথমে বাঁশের তৈরি রথে যাত্রা হতো, ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ধামরাইতে বালিয়াটির জমিদারদের অর্থায়নে ৬০ ফুট উঁচু রথ নির্মিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই ঐতিহাসিক রথটি পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পরবর্তীকালে বিখ্যাত দানবীর এবং সমাজসেবক রণদা প্রসাদ সাহার প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্টের অর্থায়নে নির্মিত হয় বর্তমানের ধামরাই রথটি। ৩৫০ বছর পেরোলেও বিন্দুমাত্র কমেনি ধামরাই রথযাত্রার জৌলুস। পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংসতার পরেও থেমে যায়নি ঐতিহ্যবাহী ধামরাই রথযাত্রা। আজ ৩৫০ বছরে পা দেওয়া ধামরাই রথ দিনে দিনে হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
৫) গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা:- হুগলির গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রার বয়স প্রায় ৩০০ বছর। ১৭৪০ সাল নাগাদ স্বামী মধুসূদনানন্দ মতান্তরে পীতাম্বরানন্দ এই রথযাত্রার সূচনা করেন। এই রথকে বলা হয় বৃন্দাবন জিউ এর রথ। গুপ্তিপাড়া রথযাত্রার একটি একান্ত নিজস্ব বিশেষত্ব আছে। এখানে ভাণ্ডার লুঠ হয়। ভারতবর্ষের কোথাও এই ভাণ্ডার লুঠ হয় না। ভাণ্ডার লুঠের পেছনে একটা গল্প আছে। একবার মা লক্ষ্মীর সঙ্গে মন কষাকষি হওয়ায় প্রভু জগন্নাথ লুকিয়ে মাসির বাড়িতে আশ্রয় নেন। মা লক্ষ্মী ভাবলেন, স্বামী বোধহয় পরকীয়ায় জড়িয়েছেন। শ্রী বৃন্দাবনের কাছে জানতে পারলেন প্রভু জগন্নাথ রয়েছেন মাসির বাড়িতে। স্বামীর মতিস্থির করাতে লক্ষ্মী লুকিয়ে ওই বাড়িতে ‘সর্ষে পড়া’ ছিটিয়ে আসেন, পরে জানতে পারেন মাসির বাড়ির উপাদেয় খাদ্য সমুহের জন্যেই প্রভু জগন্নাথ নাকি আসতে পারছেন না। তখন মা লক্ষ্মীর অনুরোধে শ্রী বৃন্দাবন লোকলস্কর নিয়ে যান মাসির বাড়ি, গিয়ে দেখেন, তিনটি দরজাই বন্ধ। দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে তাঁরা সারি সারি মালসার খাবার লুঠ করে নেন, শেষে প্রভু জগন্নাথ মনের দুঃখে মা লক্ষ্মীর কাছে ফিরে আসেন। এই সম্পর্কে প্রফুল্লকুমার পান মহাশয় তাঁর ‘গুপ্তিপাড়ায় শ্রী শ্রী বৃন্দাবন জিউর আবির্ভাব ও রথযাত্রা’ বইতে এর পরিচয় দিয়েছেন এ ভাবে — “লন্ডভন্ড হয়ে যায় ভোগ উপাচার।/ তাতে জগন্নাথে হয় চেতনা সঞ্চার।” উল্টোরথের দিন এই ভাণ্ডার লুঠ হয়। মাটির এক-একটা মালসায় প্রায় পাঁচ কিলো করে প্রসাদ। এরকম মালসার সংখ্যা চারশোরও বেশি। এগুলো লুঠ করাই হল ভাণ্ডার লুঠ।ভান্ডার লুটের জন্য গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, কুমড়ো ভাজা, ছানার রসা, পায়েস, ক্ষীর, মালপোয়া, সন্দেশ, ও রাবড়ি সহ মোট ৫২টি পদে খাবার সহ প্রায় ৫৫০ টি মালসা তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিটি মালসা প্রায় ৫ থেকে ৮ কেজি করে খাবার থাকে। এই কর্ম যজ্ঞের জন্য ১০ জন রাঁধুনি ও ১০ জন সহায়ক সহ মােট ২০ জন রান্নার কাজ করেন। নিয়ম মেনে দুপুর দুটোর আগেই সমস্ত খাবার তৈরি করে মালসায় সাজিয়ে মাসির বাড়িতে রাখা হয়। বিকেল ৩ টায় মাসির বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। গুপ্তিপাড়ার রথ ও মেলা দেখতে এবং ভান্ডার লুটের প্রসাদ পেতে মানুষ আসেন দুরদুরান্ত থেকে
৬)গোপীবল্লভপুর : গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের দুই মুখ্য আচার্য – শ্যামানন্দ প্রভু ও রসিকানন্দ প্রভু, এবং তত্তত্ব বিচারে গৌরাঙ্গভিন্ন অবতার। জগন্নাথ পুরী পরিভ্রমণের সময়, রসিকানন্দ প্রভুকে স্বয়ং মহাপ্রভু জগন্নাথ কৃপা করে নির্দেশ করেন যাতে তিনি প্রভু গোবিন্দের এক সুন্দর বিগ্রহ নির্মাণ করে তাঁর পূজা করেন। ভাগ্যক্রমে, রসিকানন্দ প্রভু তখন দুই দক্ষ মূর্তিকার—রঘুনাথ ও আনন্দ — এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি এই দুইজনকে সঙ্গে নিয়ে থুরিয়াতে যান, যেখানে তিনি শ্যামানন্দ প্রভুর সঙ্গে মিলিত হন। পরিচয়ের পর, শ্যামানন্দ প্রভু এই দুইজনকে দীক্ষা প্রদান করেন। এরপর শ্যামানন্দ, রসিকানন্দকে মহাপ্রভু জগন্নাথের আদেশ মোতাবেক গোবিন্দ দেবের বিগ্রহ নির্মাণের নির্দেশ দেন।
পরে, রঘুনাথ ও আনন্দ দ্বারা তিনটি বিগ্রহ নির্মিত হয়। প্রথম দুটি বিগ্রহ থুরিয়া ও শ্যামসুন্দরপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়। থুরিয়াতে যে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়, তার নাম রাখা হয় শ্রী বৃন্দাবন-চন্দ্র। তৃতীয় বিগ্রহটি, যা নির্মাণ করা হয়, তা গোপীবল্লভপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নামকরণ করা হয় গোবিন্দ রায়।
আজও গোপীবল্লভপুরে শ্রী গোবিন্দ দেবের সহিত জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহ ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হয়ে আসছে। রথযাত্রার পাশপাশি মূলত এই মন্দিরের স্নানযাত্রা উৎসব ও সমানভাবে আকর্ষণীয়। আনুমানিক ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়েছিল এই প্রথা। বঙ্গদেশ এবং উৎকল তথা ঝাড়খন্ড বাসী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভক্তদের আনাগোনা হয় স্নানযাত্রা থেকে শুরু করে রথের উৎসব পর্যন্ত
Reference/ research by: Shri Soumyadeep Banerjee & Tapobrata Saha, Gaudiya Yuva Shakti.